টিনের চাল

# _গল্প_টিনের_চাল
লেখক : পরীর বর
- নিলয় শোনো,আমাদের ঘরের চালটা কিন্তু টিনের হবে!
সেদিন নিলয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছিল নিশিতাকে -- মানে কি বলছি তুমি?
-- মানে টানে কিছুই না,আমি যা বলছি তাই হবে।
-- কিন্তু টিনের চাল হবে কেন?
-- টিনের চালওয়ালা ঘর আমার ভালো লাগে তাই হবে!
-- ভালো লাগে কেন?
-- উফফফ,সব কিছু কি এখনি বলতে হবে নাকি!বিয়ের পর সব বলবো।
-- হা হা....
-- কি হলো, হাসলে যে?
-- তোমার কথা শুনে!
-- আমি কি এমন বললাম যে আমার কথা শুনে তোমার হাসি পেল?
-- এই যে বিয়ের কথা বললে তাই হাসি পেলো!
-- বিয়ের কথা বলছি তাতে হাসির কি হলো?
-- তুমি হলে বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে আর তুমি কিনা বিয়ে করবে আমাকে,আর তোমার বাবার কি খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই নাকি যে আমার মতন একটা কৃষকের ছেলের কাছে তার মেয়ে বিয়ে দিবে।
-- শোনো বেশি কথা বলবা না,আমি তোমাকেই ভালোবাসি আর তোমাকেই বিয়ে করব।বাবাকে আমি তোমার আর আমার কথা সব বলেছি।বাবা তোমাকে আগামী শুক্রবার দেখা করে কথা বলতে বলেছে।
-- আচ্ছা বুঝলাম।কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতেছিনা!
-- কি কথা?
-- তুমি হলে বড়লোক বাবার মেয়ে,তোমার জন্য কত বড়লোক বাবার স্মার্ট ছেলে আছে।আর তুমি কিনা আমাকে,গ্রামের একটা ক্ষ্যেত কে ভালোবাসো।
-- শোনো এত বেশি বুঝ কেন!আমি ওরকম টাকা পয়সা আর স্মার্ট ছেলে চাইনা, আমি শুধু তোমাকেই চাই,তোমার নিরবতা,তোমার সরলতা তোমার ওই ক্ষ্যেত মার্কা লুকিং এগুলাই আমি চাই বলেই হেসে দিলো নিশিতা।
নিশিতার হাসির তালে নিলয়ও তাল মিলালো।
ঋতুটা ছিল বর্ষাকাল। তখনি বিয়ে হয়েছিল নিলয় আর নিশিতার।নিশিতার বাবা শহরের একজন নাম করা ব্যবসায়ী কিন্তু একমাত্র মেয়ের ভালোবাসার কথা ফেলতে না পেরে গ্রামের কৃষক পরিবারের নিলয়ের সাথেই মেয়েকে বিয়ে দেন তিনি।নিশিতার বাবা নিলয়কে বলছিল ঢাকার ফ্লাটে তার পরিবারকে নিয়ে আসতে আর তার কোম্পানিতে জব করতে,, কিন্তু নিলয় নিশিতার বাবার কোম্পানিতে জব করতে রাজি হলেও গ্রামের নির্মল আলোবাতাস ছেড়ে শহরে যেতে চায়নি এমনকি নিশিতাও নিলয়ের কথায় সায় দিয়ে বাবার ফ্লাটে ঊঠতে রাজি হয়নি।
নিশিতার বাবা বলেছিল গ্রামেই নিলয় আর নিশিতার জন্য ছোটখাটো বিল্ডিং ঘর বানিয়ে দিবে তখন নিলয় কিছু বলার আগেই নিশিতা বলেছিল -- না বাবা,আমি গ্রামের ওই রঙীন টিনের ঘরেই থাকতে পারব। বিল্ডিং ঘরে থাকার হলে তো আমি তোমার ফ্লাটে গিয়েই থাকতাম।
সেদিন আর নিশিতার বাবা আর কোন কথা বাড়ায়নি।মা মরা একমাত্র মেয়ের সব কথাই তিনি মেনে নিয়ে "২২শে শ্রাবণ" নিলয়ের সাথে নিশিতার বিয়ে দিয়ে দেন....
বাসর রাতে নিলয় নিশিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলো -- এখনো তো বলবে?
নিশিতা অবাক হয়ে বলেছিল -- কি বলবো?
-- তোমার টিনের চাল এত ভালো লাগে কেনো?
সেদিন নিশিতা হেসে বলেছিল -- এই যে এখন বর্ষকাল, যখন বৃষ্টি হবে তখন বৃষ্টির ফোটা টিনের চালের ঊপর পরবে তখন একটা শব্দ হবে সেই শব্দটাই আমার কাছে অনেক প্রিয়। প্রথম যেদিন গ্রামে খালার বাসায় গিয়ে টিনের চালের নিচে থেকে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনেছিলাম সেদিন থেকেই টিনের চালের প্রতি এক অন্যরকম আকর্ষনের সৃষ্টি হয়েছিল। এই যে এখন বাহিরে মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, কি সুন্দর এই বৃষ্টি শব্দ,যা একমাত্র গ্রামের এই ছোট্ট কুটিরে থেকেই বুঝা যায়।
শহরের বড় দালানের ভেতরে এই শব্দ শুনতে পাওয়া যায়না। শহরের বড় দালানের ভেতরে তো বিদুৎ চমকালে, বাজ পরলে তার শব্দ তেমন দেখাও যায়না, শুনাও যায়না।কিন্তু টিনের ঘরে থেকে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনা যায়,বিদুৎ চমকালে তা দেখা যায়,বাজ পড়ার শব্দ শুনা যায়।
এই শোনো,যখন বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে বিদুৎ চমকাবে,বাজ পড়বে তখন আমি ভয় পেয়ে তোমাকে জরিয়ে ধরবো, তুমি কিন্তু না করতে পারবে না এই আমি বলে দিলাম হু।
-- আমাকে জরিয়ে ধরবে কেনো?
-- বাড়ে, যখন বৃষ্টি পরে,বিদুৎ চমকায়, বাজ পরে তখন আমার ভয় করেনা বুঝি,তাই ভয় পেয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরব……………:বলার সাথে সাথেই প্রচণ্ড জোরে একটা বাজ পরল সাথে বিদুৎ ও চমকালো।নিশিতা ভয়ে পেয়ে নিলয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিলয় নিশিতার দিকে তাকিয়ে হেসে সেও নিশিতাকে তার বুকে মধ্যে শক্ত করে জরিয়ে ধরেছিল।
হঠাৎ একদিন এক কালো ঝড় এসে উলটপালট করে দিয়ে যায় সব।নিলয় নিশিতাকে বলেছিল - এত তাড়াতাড়ি বেবি না নিতে কিন্তু কে শুনে কার কথা।নিশিতার জোরাজুরিতে বিয়ের ২য় বছরই তাদের কোল জুরে আসে নিলয় আর নিশিতার মেয়ে নিলাদ্রী।
নিলাদ্রীর জন্মের পর নিশিতা নিলয়ের হাত ধরে বলেছিল -- নিলয় আমি হয়তো আর বাঁচবো না,কিন্তু আমি আমার অস্তিত্ব আমাদের মেয়েকে আমি রেখে গেলাম তোমার কাছে।তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমার নিলাদ্রী কে কখনওই কষ্ট দিও না প্লিজ। নিলাদ্রীর মাঝেই তুমি আমাকে খুজে নিও আমার থেকেও আমার নিলাদ্রী কে বেশি ভালোবাসবা, আমার মেয়েকে কখনওই কোন কষ্ট দিও না।
এপারে হয়তো আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারব না কিন্তু দেখো আল্লাহর রহমতে আমরা ওপারে ঠিকই একত্রে থাকব তখন আর আমরা আলাদা হবো না।
এরকম আরো অনেক কথা বলেই হাসপাতালের বেডেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল নিশিতা।
-- কিরে নিলয় বাসায় যাবিনা নাকি আজও বউমার কবরের পাশেই বসে থাকবি?
নিশিতার কবরের পাশে বসেই এতক্ষন পুরানো অতীত ভাবছিল নিলয়। নিশিতার কবরের চারপাশে খুটি গেড়ে কবরের উপরে টিনের চাল দিয়ে দিছে নিলয়।কারন তার নিশিতার যে টিনের চালের শব্দ ভালো লাগতো। হঠাৎ করে বাবার ডাকে ধ্যান ফিরল নিলয়ের। নিলয় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কোন কথা নেই তার মুখে। বাবা আবার জিজ্ঞেস করল -- কি রে বাসায় যাবিনা।আর কতক্ষণ এভাবে বউমার কবরের পাশে বসে থাকবি?প্রতিদিনই তো এখানে এসে বসে থাকিস,আবার বাসায় চলে যাস,আজ আবার কি হলো যে এখনো বাসায় ফিরলি না।
-- বাবা আজ যে "২২শে শ্রাবণ "আমার আর নিশিতার ৩য় বিবাহ বার্ষিকী। যেদিন আমাদের বিয়ে হইছিল সেদিন মুষল ধারে বৃষ্টি হয়েছিল,বাজ পরেছিল,বিদুৎ চমকাচ্ছিলো।দেখনা বাবা আজও আকাশে কালো মেঘ ঘুরঘুর করছে।কখন জানি বৃষ্টি নেমে পরে।বৃষ্টি নামলে,বাজ পরলে বিদুৎ চমকালে তো আমার নিশিতা ভয় পায়।আমি কি করে নিশিতাকে এখানে একা রেখে চলে যাব।আমি কাছে না থাকলে যে আমার নিশিতা ভয় পাবে।
-- কিন্তু এভাবে আর কতদিন, কত করে বললাম আরেকটা বিয়ে কর।তা না, তোর কথা না হয় বাদ দিলাম,একবার মেয়েটার কথা ভাব।তারও তো একজন মায়ের দরকার,এভাবে আর কতদিন থাকবি বলতে পারিস?
-- আমি বিয়ে করব না বাবা,আমার মেয়ে আমিই বাবা আমিই ওর মা।নিশিতা আমাকে বলেছিল আমি যাতে তার মত করেই আমাদের নিলাদ্রী কে ভালোবাসি।আমি চাইনা সৎ মা এসে নিলাদ্রী কে কষ্টে রাখুক,তাহলে যে আমি আমার নিশিতার কথা রাখতে পারব না।আমিই আমার মেয়ের মা বাবা।ওর নতুন কোন মায়ের দরকার হবেনা।
-- তা না হয় বুঝলাম,এবার নাহয় বাসায় চল।নিলাদ্রী সেই কখন থেকে কান্না করতেছে।তোকে না পেলে কি সেই কান্না থামবে।
-- আমি চলে গেলে যে আমার নিশিতা ভয় পাবে,ও যে আমাকে স্বার্থপর ভাববে বাবা।
-- দেখ বাবা,মানুষ মরণশীল, একদিন না একদিন সবাই মারা যাবে।কেও আগে বা কেও পরে।আল্লাহর ইচ্ছাতেই বউমা আমাদের ছেরে চলে গেছে।তুই তো বললি নিলাদ্রী কে বউমা তার মতন করেই ভালোবাসতে বলেছে।এখন যে নিলাদ্রী তোকে না পেয়ে কান্না করতেছে এতে কি বউমা কষ্ট পাবেনা,তোকে না পেয়ে যে তোর মেয়ে কান্না করছে এতে দোষটা তো সম্পুর্ন তোর।তাই এখন আর কথা না বলে বাসায় চল..............
এমন সময় ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পরতে লাগলো।
-- বাবা বাবা, বাতাস আতো,বিত্তি পলতাতে তো।
নিলয় পেছনে তাকিয়ে দেখল নিলাদ্রী ছোট একটা ছাতা নিয়ে তার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে।নিশিতার কবরটি নিলয়ের রুমের পাশেই,নিলাদ্রীর পেছনে দেখা গেলো নিলয়ের মা দাঁড়িয়ে আছে।তাহলে নিশ্চয় মা ই নিলাদ্রী কে নিয়ে এসেছে। ভাবনাচিন্তার মাঝেই নিলাদ্রী এসে নিলয়ের বুকে লুটিয়ে পরল।নিলয় মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। দাড়ানোর সাথে সাথেই নিলয়ের চোখ থেকে দু ফোটা লোনা জল গাল বেয়ে মাটিতে পরল।
নিলয় মেয়েকে নিয়ে ঘরে যেতে যেতে মনে মনে বলল -- আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও নিশিতা।আমি যে নিলাদ্রীর কারনে তোমাকে একা রেখে চলে গেলাম।এখন যে বৃষ্টি পরছে,বিদুৎ চমকাচ্ছে,বাজ পরছে আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া একা একা ভয় পাচ্ছ,আমি যে তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না,,শুধু তোমাকে ভালোবেসে তোমার ভালোলাগার টিনের চালটা তোমার কবরের উপরে দিয়ে দিলাম,যাতে করে তুমি টিনের উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে পাও।
মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে এক হাতে চোখের পানি মুছে ঘরে চলে গেল নিলয়।আর এদিকে বৃষ্টির বেগও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে লাগল।নিশিতার কবরের উপরে টিনের চালের উপর বৃষ্টি পরছে, টিনের চালের উপরে বৃষ্টি পড়ার ফলে অন্যরকম একটা শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে,আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে এই বৃষ্টির শব্দ নিলয়ের নিশিতা শুনতে পাচ্ছে কি না?
বেঁচে থাকুক সবার ভালোবাসা
বেঁচে থাকুক ভালোবাসার মানুষগুল।

Comments

Popular Posts